২০২০ সালের ২৩ শে সেপ্টেম্বর বিবিসি বাংলা রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বের ১৭২ টি দেশে কাজ নিয়ে যায় বাংলাদেশিরা। প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে সরকারি ও বেসরকারিভাবে ২০ লক্ষ কর্মী বিদেশে যান বলে জানিয়েছে বায়রা, যাদের অধিকাংশই শ্রমিক ভিসাতে যায়। ২০২২ অর্থ বছরে প্রবাসী আয় প্রায় ২১ বিলিয়ন ডলারের মতো এসেছিল। অর্থাৎ একজন শ্রমিক যদি গড়ে ৩০০০০-৫০০০০ টাকা ইনকাম করে এবং ৩০% পারসেন্ট যদি সে তার পরিবারের জন্য বাংলাদেশে পাঠায় তাহলে এই সমপরিমাণ টাকা বাংলাদেশে আসে। আসুন অংকটা এবার অন্যভাবে করি, আমরা যদি তথ্য ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে দক্ষ জনশক্তি ২০ লক্ষ পাঠাতে পারি তাহলে তার ন্যূনতম ইনকাম হবে ৩ লক্ষ টাকার মত এবং আপনার ইনকাম যখন বেশি থাকবে তখন অবশ্যই আপনি পরিবারের জন্য বেশি খরচ করবেন সে ক্ষেত্রে ৪০% যদি তার পরিবারের জন্য রেমিটেন্স পাঠায় তাহলে প্রতি বছর ৬৫ বিলিয়ন অতিরিক্ত রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয় করা সম্ভব। এইভাবে আমরা যদি শুধুমাত্র দশটি বছর এই ক্ষেত্রে সঠিকভাবে মন দিতে পারি তাহলে আমাদের অর্থনৈতিক ও দেশের সামগ্রিক অবস্থান বহির্বিশ্বের মাঝে কোথায় যেয়ে টিকবে চিন্তা করুন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স এর তথ্য বলছে, ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী বাংলাদেশের মোট তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি। যা মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশের বেশি। ২০২৩ সালে রিপোর্ট অনুযায়ী নিষ্ক্রিয় তরুণের হার প্রায় ৩৫ শতাংশ অর্থাৎ এক কোটি ২০ লাখের মতো। যদি এখন থেকেই তরুণদের স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক নিরাপত্তা এবং তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা নিশ্চিত করা যায় তাহলে ভবিষ্যতের জন্য হবে এটি বাংলাদেশের সেরা বিনিয়োগ। আর এই বিনিয়োগ সঠিকভাবে যদি শুধুমাত্র প্রযুক্তিশিক্ষা খাতে দেওয়া যায় তা হবে সহজে ইনভেসমেন্ট সহ উঠে আসার একটি অপার সম্ভাবনা, যা বাংলাদেশকে শুধুমাত্র অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করবে না সারা বিশ্বে মেধাভিত্তিক শ্রমবাজারের সর্বোচ্চ শিখরে নিয়ে যেতে পারে।
বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে তথ্য ও প্রযুক্তি। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির ফলে সারা বিশ্ব আজ গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে। ফলে সারা পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। পুরো পৃথিবীটাই এখন আমাদের গ্রামের মতো যখন খুশি সবাই সবার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। এটাকেই বলা হয় ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ (বৈশ্বিক গ্রাম)। আর এটা সম্ভব হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির ফলে। বাংলাদেশ এ আসলেই কি তাই? গ্লোবাল ভিলেজ বলতে শুধুমাত্র ইন্টারনেট কানেকশন এ কানেক্টেড থাকাতেই সন্তুষ্ট মনে করছি আমরা।
সারা বিশ্বে বাংলাদেশে যে সস্তা শ্রমবাজারের পরিচিতি লাভ করেছে সেখান থেকে বের হয়ে তথ্যপ্রযুক্তিতে প্রযুক্তিভিত্তিক মেধা শ্রমবাজার এর তকমা সহজেই লাগানো যায়। তবে এর জন্য প্রয়োজন প্রাথমিক পর্যায়ে থেকে তথ্যপ্রযুক্তির প্রতি শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মনোযোগ আকর্ষণ করা। শুধুমাত্র হাইটেক পার্ক বা ফ্রিল্যান্সার বা ডিজিটাল ট্রেনিং করলেই হবে না একজন শিক্ষার্থী যেন অ’ তে অজগর আ’ তে আম অথবা A ফর অ্যাপল B ফর Ball এর সাথে A ফর অ্যাবাকাস ব B ফর Bluetooth বা C ফর Computer তার কিন্ডার গার্ডেন শিক্ষা জীবনের শুরু থেকেই শিখতে পারে। আর সেটি তখনই সম্ভব হবে যখন শিক্ষক, অভিভাবক, সরকার, স্টেক হোল্ডার ও শিক্ষার্থীদের আমরা এক মননে আনতে পারব। সেটার জন্য প্রয়োজন তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষাকে প্রতিটি ক্ষেত্রে জনপ্রিয় করে তোলা।
বিশ্বে বাংলাদেশ এখনো সস্তা শ্রমবাজার হিসেবে পরিচিত, কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে পারলে সেই পরিচিতি বদলানো সম্ভব। তবে এর জন্য প্রয়োজন প্রাথমিক পর্যায় থেকেই তথ্যপ্রযুক্তির প্রতি শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মনোযোগ আকর্ষণ করা। শুধুমাত্র হাইটেক পার্ক, ফ্রিল্যান্সিং বা ডিজিটাল ট্রেনিংয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেই হবে না; শিক্ষার্থীদের এআই, ব্লকচেইন, রোবটিকস, ক্লাউড কম্পিউটিং, সাইবার সিকিউরিটি, ওয়েব ৩, মেশিন লার্নিংয়ের মতো আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত করতে হবে। দরকার প্রযুক্তি ভিত্তিক শিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া। আমাদের বিশ্বাস থাকতে হবে আমরা যদি কাপড় বানাতে পারি তাহলে আমরা রোবট বানাতেও পারবো। এখন এই রোবট বানাতে হলে কাগজে-কলমে শুধুমাত্র সেমিনার, ট্রেনিং, ইনকিউবেশন সেন্টার বা হাইটেক পার্ক করলেই হবে না শিক্ষার্থীদের শিক্ষাকারিকুলামে রোবট শিক্ষাকে এমনভাবে জনপ্রিয় করতে হবে যাতে তারা রোবট সম্পর্কে নিজ উদ্যোগে শিক্ষা গ্রহণ করে।
আর সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে আইসিটি অলিম্পিয়াড বাংলাদেশ ট্রাস্ট, যার যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০২১ সালে, অনেক চড়াই উৎরায় পেরিয়ে ২০২২ সালে প্রথম পর্বে প্রায় ২০০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ১৮,০০০ শিক্ষার্থীদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল। ছিল অনেক প্রতিকূলতা। সেগুলো কাটিয়ে শুরু হতে যাচ্ছে সিজন টু। আরো বেশি পরিপক্ক আরো বেশি সচেতন হয়ে। আইসিটি অলিম্পিয়াড বাংলাদেশ এ সংযুক্ত আছেন প্রায় ৭০ হাজার শিক্ষার্থী, ১০০০ এর বেশি আইসিটি শিক্ষক, ৩০০০ বেশি আইসিটি অ্যাম্বাসেডর এবং ৬১টি বেশি তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি। বর্তমান সময়ের বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে ১৫টি তথ্যপ্রযুক্তি সেগমেন্ট নিয়ে তথ্যপ্রযুক্তি জ্ঞান ভিত্তিক এই প্লাটফর্ম কাজ করে যাচ্ছে। আইসিটি অলিম্পিয়াড বাংলাদেশের মুল লক্ষ্য তথ্য প্রযুক্তি শিক্ষাকে জনপ্রিয় করে তোলা কোন ইভেন্ট বা প্রতিযোগিতা বা কোর্স করানো নয়।
আইসিটি অলিম্পিয়াড বাংলাদেশের ফাউন্ডার ও সিইও মোহাম্মদ শাহরিয়ার খান একজন তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ও টেক অন্ট্রাপ্রেনিওর। নিজের সফটওয়্যার ব্যবসার পাশাপাশি বেশ কিছু টেক স্টার্টআপ এ রয়েছে তার সম্পৃক্ততা। কম্পিউটার বিজ্ঞানে পড়াশোনার করে চাকরি ও ব্যবসার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আইসিটি শিক্ষা কে সারা বাংলাদেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশকে তথ্য প্রযুক্তিতে ব্রান্ডিং করার জন্য নিরবে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি স্বপ্ন দেখেন আইসিটি হবে বাংলাদেশের অন্যতম রপ্তানি পণ্য। তার জন্য দরকার শুধুমাত্র আন্তরিকতা আর এই আন্তরিকতাটা হতে হবে একজন শিক্ষার্থীর প্রথম শ্রেণী থেকেই।
কিন্তু সামগ্রিক পরিস্থিতি অন্যরকম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৬০-৭০ শতাংশ ডিজিটাল ল্যাবের অবস্থা করুণ। ডেক্সটপ ও ল্যাপটপ যেগুলো দেয়া হয়েছিল তা সঠিক ব্যবহারের কারণে হয়ে গেছে অনুপযোগী। শিক্ষার্থীদের ব্যাবহারিক পরীক্ষার নম্বর দেয়া হয় অনুমানের ওপর ভিত্তি করে। এর ফলে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাবহারিক জ্ঞান বলতে কিছুই নেই । এমনও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আছে যেখানে একটি মাত্র কম্পিউটার আছে শিক্ষক ব্যবহার করেন অন্য শিক্ষার্থীরা পেছনে দাঁড়িয়ে দেখেন। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আইসিটির শিক্ষক নেই যারা আছেন অনেকে শিক্ষকদের নেই সঠিক ব্যবহারিক আইসিটি ট্রেনিং।
বিশ্বায়নের এই সময়ে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায় তা শুধু এওয়ার্ড ফাংশন ট্রেনিং কর্মশালা ও বিভিন্ন স্থাপত্য প্রজেক্ট এ কাগজে-কলমে এর মাধ্যমে সীমাবদ্ধ রাখলেই হবে না, এর সঠিক অবস্থান নিরূপণ করা দরকার। শুধুমাত্র পার্শ্বপ্রতী দেশ ভারতের সাথে আমাদের অবস্থান চিন্তা করলেই আমরা বুঝতে পারবো কতটা পিছিয়ে আছি। তিনি সরকারি ও বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশের তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রে বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তির শিক্ষা ক্ষেত্রে এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।
তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প একটি আপার সম্ভাবনা এই অপার সম্ভাবনার যেন অচিরেই অপমৃত্যু না হয় সেদিকে সরকারের সঠিকভাবে নজর দেয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন। আর এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে জোর করে আইসিটি শিক্ষা চাপিয়ে দিলেই হবে না, তার জন্য দরকার আইসিটি শিক্ষাকে জনপ্রিয় করে তোলা। সেই কাজটি করে যাবে আইসিটি অলিম্পিয়াড বাংলাদেশ।