ধেয়ে আসছে বড় বিশ্বযুদ্ধ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক :

0

গাজা পরিস্থিতি গত জুলাই থেকেই নতুন দিকে মোড় নেয়। বিশেষত তেহরানে হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া ও বৈরুতে হিজবুল্লাহর জ্যেষ্ঠ কমান্ডার ফুয়াদ সুকর হত্যার পর আক্ষরিক অর্থেই পরিস্থিতি অনেকটা জটিল হয়ে ওঠে। দুই ক্ষেত্রেই দুটি সশস্ত্র গোষ্ঠী শুধু নয়, দুটি স্থানকে আক্রান্ত করা হয়েছে। বিশেষত তেহরানে ইসমাইল হানিয়ার হত্যার মধ্য দিয়ে তেহরানও যে ইসরায়েলের হাত থেকে নিরাপদ নয়, সেই বার্তা দেওয়া হয়েছে। এতে গাজা যুদ্ধের বৃহত্তর যুদ্ধে রূপান্তরের বড় ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

এমনিতে গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া সংঘাত আর গাজায় সীমাবদ্ধ নেই। ইসরায়েলি গোলায় বা তাদের অবরোধের কারণে ক্ষুধা‑তৃষ্ণায় ফিলিস্তিনিদের মৃত্যু এখন অনেকটাই ‘সাধারণ’ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ড্রোন‑ক্ষেপণাস্কত্র ইত্যাদির মাধ্যমে হিজবুল্লাহর এই যুদ্ধে সংযোগও ঘটে গেছে অনেক আগেই। আর মুখে শান্তির কথা বলে অশান্তির সব আয়োজন সম্পন্ন করা সেই মার্কিন গোষ্ঠীর পর্দার আড়ালের নড়াচড়া তো আর অপ্রকাশ্য কোনো বিষয় নয়। ফলে এক রকম আঞ্চলিক যুদ্ধে পরিণতি পাওয়ার সব উপাদান এই যুদ্ধের এমনিতেই আছে। এর সাথে ইরান কোনোভাবে সরাসরি যুক্ত হলে সামরিক সক্ষমতা বিচারে, বিশেষত পারমাণবিক অস্ত্রের মালিকানা থাকার বিচারে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।

গাজা যুদ্ধ যে এরই মধ্যে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধে পরিণত হয়েছে, তার বহু নজির সামনে আনা যায়। কয়েকটির কথা উল্লেখ করা যাক। গাজায় ইসরায়েলি হামলা শুরুর কিছু পরই এতে হামাস ও গাজার পক্ষে দাঁড়ায় হিজবুল্লাহ। লেবানন থেকে এই সশস্ত্র গোষ্ঠী ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে একের পর এক হামলা চালায়, যা এখনো অব্যাহত। ইয়েমেন থেকে যোগ দিয়েছে হুতিরা। তারা লোহিত ও আরব সাগরে চলাচলকারী বাণিজ্যিক জাহাজ লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে। উভয় গোষ্ঠীই হামলার ক্ষেত্রে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন। হুতিদের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র এমনকি তেল আবিবেও আঘাত করেছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ইরাক ও সিরিয়ার সশস্ত্র গোষ্ঠী।

 

ফরেইন অ্যাফেয়ার্স ম্যাগাজিনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, মধ্য‑এপ্রিলে দামেস্কে ইরান দূতাবাসের কাছে বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। প্রত্যুত্তরে ইরান ইসরায়েলে সাড়ে তিন শর বেশি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়। এতে এই দুই দেশের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধ বাধার শঙ্কা তীব্র হয়। একই সময়ে ইরান পশ্চিম তীরে অর্থ ও অস্ত্র সহায়তা বাড়ায়। পাশাপাশি ইসরায়েলের অভ্যন্তরেও নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে তেহরান চেষ্টা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

 

এখন পর্যন্ত আঞ্চলিক এই যুদ্ধ তেমন তীব্র না হলেও তীব্র হয়ে ওঠার সব উপাদানই এর মধ্যে রয়েছে। ১৯৭৩ সালের আরব‑ইসরায়েল যুদ্ধের পর ইসরায়েল বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলা ও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লেও কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়াতে হয়নি। ফলে ছোট ছোট যুদ্ধ ও সংঘাতের মধ্য দিয়ে ইসরায়েল যে নিরাপত্তা কৌশল গড়ে তুলেছিল, তা সেভাবে প্রশ্নের মুখে পড়েনি। কিন্তু এবার পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন।

ইসরায়েল সব সময়ই পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে জড়ানোর বদলে প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে ছোট ছোট সংঘাত, দমন বা যুদ্ধে জড়িয়েছে। কারণ, ভৌগোলিক আয়তন ও জনসংখ্যা কোনো বিচারেই পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ জড়ানোর কৌশল তার পক্ষে নেওয়া ঠিক বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কিন্তু এবার প্রায় এক বছর ধরে হামাসের সাথে গাজায় এবং উত্তর সীমান্তে লেবাননের হিজবুল্লাহ গোষ্ঠীর সাথে যুদ্ধ এই কৌশলকে প্রায় কবর দিয়ে ফেলেছে বলা যায়। সাথে রয়েছে ইসরায়েলের ঘরের ভেতরের অস্থিরতা। গত কয়েক বছর ধরেই দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। যুদ্ধরত নেতানিয়াহু প্রশাসন নিজেই সমালোচনার মুখে। ফলে এই সময়ে হামাস, হিজবুল্লাহ, হুতিদের মতো ইরান সমর্থিত অন্য গোষ্ঠীগুলোও যদি পূর্ণ শক্তিতে যুদ্ধে নামে, ইসরায়েলের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন হবে নিঃসন্দেহে।

 

তেমনটি ইসরায়েল কী করবে? এই প্রশ্নের উত্তরে ফরেইন অ্যাফেয়ার্স বলছে, নিশ্চিতভাবেই ইসরায়েল তার সামরিক শুধু নয়, অর্থনৈতিক, প্রাযুক্তিক, কূটনৈতিক, রাজনৈতিক–সব সক্ষমতা নিয়েই মাঠে নামবে। বরাবরের মতোই আমেরিকাসহ পশ্চিমা মিত্রদের যুদ্ধের ময়দানে টেনে আনার চেষ্টা করবে তারা।

 

ফরেইন অ্যাফেয়ার্স যা বলেনি, তা হলো–এর মধ্যে আমেরিকা এরই মধ্যে তার হয়ে মাঠে উপস্থিত। সেটা কী মাত্রায়, তা আমেরিকায় ফিলিস্তিনের পক্ষে এবং যুদ্ধের বিরুদ্ধে হওয়া কিছুদিন আগের ছাত্র বিক্ষোভই প্রমাণ করে। একই পরিস্থিতি ফ্রান্স, জার্মানিতেও। অস্ট্রেলিয়াতে এই গত সপ্তাহেই একই ধরনের বিক্ষোভ হলো। সেখানেও বিক্ষোভকারীদের স্লোগান ছিল ফিলিস্তিন ও গাজার পক্ষে। আমেরিকা ও ইউরোপজুড়ে গত কয়েক মাসে হওয়া যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভের মূল কথা হলো–অন্যায় যুদ্ধে ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নেওয়া থেকে সরে আসতে হবে। তাদের অর্থায়ন বন্ধ করতে হবে। তাদের সামরিক সহায়তা দেওয়া বন্ধ করতে হবে।

গাজায় ইসরায়েলি হামলা। ফাইল ছবি: রয়টার্স
এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে, শুধু যুদ্ধবিরোধী মনোভাব ও শান্তির প্রতি নিবেদনের কারণেই এত মানুষ বিক্ষোভে নেমেছিল। এই বিক্ষোভের পেছনে আরও কিছু বাস্তবিক কারণও ছিল। সেটা কী? নিশ্চিতভাবেই অর্থনৈতিক। গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলের পাশে থাকতে গিয়ে আমেরিকা ও এর পশ্চিমা মিত্ররা আর্থিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং অতি অবশ্যই সামরিক সহায়তা দিয়েছে ও দিচ্ছে। আর এই করতে গিয়ে অর্থনৈতিক চাপ বাড়ছে দেশগুলোতে। ফলে যুদ্ধ ও সহিংসতার বিরোধিতার সঙ্গে সঙ্গে এই অর্থনৈতিক চাপও যুক্ত হয়েছে, যা মানুষকে বিক্ষুব্ধ করছে।

গত বছরের অক্টোবরে যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই বোঝা যাচ্ছিল যে, এটি গত কয়েক দশকে হওয়া আর দশটা ইসরায়েলি হামলার মতো নয়। ইসরায়েলের হামাসের বিরুদ্ধে করা যুদ্ধ ঘোষণাও কোনো গালভরা ঘোষণা নয় শুধু। এ সত্যি সত্যি যুদ্ধ। সময়ের সাথে এই যুদ্ধে আগেই বলা হয়েছে ইরানের প্রতিরোধ অক্ষশক্তিগুলো যুক্ত হয়েছে। মোটা দাগে সাতটি ফ্রন্টে এখন ইসরায়েলকে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। একটি তো হামাস, যাকে নির্মূল না করা পর্যন্ত ইসরায়েল ক্ষান্ত দেবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। উত্তর সীমান্তে রয়েছে হিজবুল্লাহ। ইরান ও ইয়েমেনেও হামলা করছে ইসরায়েল। সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের নামে অভিযান চালাচ্ছে পশ্চিম তীরে। আর আছে সিরিয়া ও ইরাক। এই সবগুলোর সাথেই ইসরায়েল আমেরিকা ও পশ্চিমাদের কাছ থেকে পাওয়া সহায়তার জোরে লড়ে যাওয়ার মনোভাব দেখিয়ে যাচ্ছে। আর একের পর এক হামলায় ফিলিস্তিনিদের হত্যা করে যাচ্ছে, যেন তারা সংখ্যা ছাড়া আর কিছু নয়। এমনকি বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের জন্য করা আশ্রয় শিবির ও সেখানে পাঠানো খাদ্য সহায়তাও তাদের অবরোধ ও হামলা থেকে বাদ যাচ্ছে না। গত বছরের ৭ অক্টোবরের ১২০০ এর সাথে যুদ্ধকালে আরও ৭০০ যোগ করে যেখানে সামরিক‑বেসামরিক মিলিয়ে ইসরায়েল পক্ষে নিহতে সংখ্যা ২ হাজারের আশপাশে সেখানে গাজায় নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা বহু আগেই ৩০ হাজার ছাড়িয়েছে, যার অধিকাংশই বেসামরিক।

 

মজার বিষয় হলো ফরেইন অ্যাফেয়ার্সে প্রকাশিত প্রতিবেদনে লেখক আসাফ ওরিয়ন, ইসরায়েলের দৃষ্টিকোণ থেকেই ঘটনার বর্ণনা করেছেন। পুরো লেখায় বারবার ইসরায়েলকেই তুলে ধরেছেন আক্রান্ত হিসেবে। যেন হামাস, হিজবুল্লাহ, হুতি, সিরিয়া ও ইরাকের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ইসরায়েলকে হামলা চালিয়ে কাতারে কাতারে মানুষ মেরে ফেলছে, ধ্বংস করছে স্থাপনা। অথচ সেখানে এমনকি গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ঠিক কতজন নিহত হলো, তার কোনো পরিসংখ্যান দেওয়ার প্রয়োজন পর্যন্ত বোধ করেননি তিনি। যুদ্ধের কারণে ইসরায়েলের অর্থনীতি কতটা চাপে, সেই বয়ান আমরা তাঁর লেখায় পাই। যদিও একবারের জন্যও তিনি উচ্চারণ করেন না যে, গাজায় যুদ্ধের কারণে ফিলিস্তিনের অর্থনীতি কী ভয়াবহ পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। দেশটির পরিসংখ্যান বিভাগের তথ্যমতে, এই যুদ্ধের কারণে শুধু ২০২৪ সালেই ৭৬০ কোটি ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। এটি আরও বাড়তে পারে। কারণ, এই সময়ে সব এলাকার ক্ষতির হিসাব করা দুরূহ। যুদ্ধের কারণে দেশটির অবকাঠামোর ৭৬ শতাংশই এখন ধ্বংসপ্রাপ্ত।

 

সে যাক। ঠিক এই মনোভাবের জায়গা থেকেই কিন্তু খোদ পশ্চিমা দেশগুলোতেই শাসকেরা জনবিক্ষোভের মুখে পড়ছেন। সামাজিক মাধ্যমের এই যুগে দাঁড়িয়ে কোনো এক ব্যক্তি বা কোনো এক সংবাদমাধ্যমে তুলে ধরা পরিসংখ্যান ও ভাষ্য একপেশে কিনা, তা লুকিয়ে রাখার কোনো সুযোগ আসলে নেই। আমেরিকাসহ গোটা পশ্চিম এ বিষয়ে অবহিত হলেও সেই পুরোনো কায়দায় যুদ্ধের বাস্তবতা ও নিজেদের পাপ লুকিয়ে রাখার কৌশল থেকে তারা পিছু হটছে না। মুখে শান্তি প্রক্রিয়ার কথা বলে পর্দার আড়ালে পুর্ণ বিজয়ের ছক কষার গল্পটা প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে। আর তা যাচ্ছে বলেই মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও ইরান সমর্থিত শক্তিগুলো ক্রমে সরব হয়ে উঠছে। কিন্তু ক্ষমতার দম্ভে মার্কিন বলয় বরাবরের মতোই আসন্ন এ সংকটকে আড়াল করতে চাইছে। পূর্ণ বিজয়ের মোহে এক রকম অন্ধের মতো আচরণ করছে তারা।

 

অথচ এই যুদ্ধাবস্থা চলতে থাকলে এবং ইরানকে পোষ মানানোর উচ্চাকাঙ্ক্ষা আরও তীব্র হলে ইরান সরাসরি এই যুদ্ধে যুক্ত হয়ে যেতে পারে। তেমনটি হলে মিত্র হিসেবে না হলেও আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবেই রাশিয়া ও চীন যুদ্ধের পেছনের কারিগরের ভূমিকায় ঢুকে পড়বে নিশ্চিতভাবে। এতে যুদ্ধের ময়দান মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপ বা অন্য কোথাও স্থানান্তরিত না হলেও ওই অঞ্চল ও মিনা অঞ্চলে যে বিস্তৃতি ঘটাবে সন্দেহ নেই। আর যুদ্ধ তো শুধু ময়দানে আবদ্ধ থাকে না। পণ্যের দাম, নৈতিক অবক্ষয়, অর্থনৈতিক বহুবিচিত্র সংকটের পথ ধরে যুদ্ধ তো ময়দান থেকে অতি দূর ঘরেও প্রবেশ করে। তার ধক নেওয়ার জন্য বিশ্ব ও এর মানুষ প্রস্তুত কি?

 

 

 

 

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.